খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রায় ৩০ একর একটি বদ্ধ খাল ৩৫ বছর ধরে দখলে রেখেছেন জামাল গাজী নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথমে মৎস্য সমিতির নামে ইজারা কিনে ও পরবর্তীতে মামলার বেড়াজালে নিয়ন্ত্রণে রেখে খন্ড খন্ড বিক্রি করে আসছেন। ফলে উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের দেবদুনিয়া খালটি একদিকে দূষণের পাশাপাশি ভরাট হয়ে উঠছে। অপরদিকে, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এছাড়া খালটি লবনপানি মুক্ত করে মিঠা পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে পাশ্ববর্তী সহাস্রাধিক বিঘা এক ফসলি জমিতে শুষ্ক মৌসুমে বোরো, তরমুজ, মিষ্টি আলুসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে বলে স্থানীয় কৃষকদের দাবি।
সরেজমিন পরিদর্শন, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও বিভিন্ন কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দেবদুনিয়া খালটি একসময় অনেক প্রশস্ত ও গভীর ছিল। কোন নেট-পাটা কিংবা বাঁধ ছিল না। বর্তমানে নেট-পাটা ও বাঁধ দিয়ে নূন্যতম ১০ টি খন্ডে বিভক্ত করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ওই খন্ডগুলো লিজ দিয়ে মোটা অংকের ভাড়া (হারি) ভোগ করেন জামাল গাজী নামের এক ব্যক্তি। পানি সরবরাহ না থাকাসহ ময়লা-আবর্জনা ফেলায় দুষণ ও ভরাট হয়ে উঠছে। পাশ্ববর্তী চৌকুনী বিলের মৎস্য ঘের থেকে নোনাপানি ঢুকে পানি লবনাক্ত হয়ে উঠেছে। অপরপাশের কালিকাপুর বিলের সহাস্রাধিক বিঘা জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির অভাবে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও লবনপানির অনুপ্রবেশে আমন ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আরও জানা যায়, খালটি ৩৫ বছর যাবৎ ভোগদখলকারী জামাল গাজী বর্তমানে কয়রা সদরে বসবাস করেন। খালটি খন্ড খন্ড করে কয়েকজনের কাছে দখল বুঝে দিয়ে প্রতিবছর মোটা অংকের টাকা (হারি) ভোগ করছেন তিনি। তিনি প্রথমে ১৯৯০ সালে স্থানীয় একটি মৎস্য সমিতির নামে সরকারের কাছ থেকে ইজারা কিনে দখল নেন। এরপরে একটানা কয়েক দফায় মৎস্য সমিতির নামে ইজারা কিনে তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ২০০৯ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আয়লায় ওই এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। এরপরে তিনি ইজারা না কিনে ভোগদখল করেন। একপর্যায়ে ২০১১ সালে তার পিতা আবুল কাশেম গাজীকে বাদী করে (খালে স্বত্ব আছে বাবদ) সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ চতুর্থ আদালতে মামলা দায়ের করেন। যার নং ৬৪/১১। ওই আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞার আদেশ না পেয়ে পরবর্তীতে জামাল গাজী পক্ষ হয়ে হাইকোর্টে সিভিল রুল এফএম ৭৪৩/২০১২ রিভিশন করেন। হাইকোর্ট থেকে স্থিতাবস্থার আদেশ নিয়ে ভোগদখল করে আসছে।
তবে তার পিতা ওই মামলা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তার পিতার স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া আমলনামা তৈরি করে মামলাটি করা হয়। তার বৃদ্ধ পিতা এটা জানার পরে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য ২০১৮ সালে আবেদন করেন। পরে যুগ্ম জেলা জজ চতুর্থ আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন। এছাড়া মোঃ আবুল কাশেম তার নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে সরকারী সম্পত্তি ভোগ দখল করে আসায় তার ছেলে জামাল গাজীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১৮ সালের ৬ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন দেন। আবুল কাশেম ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি মারা যায়।
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি ৭৫তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেবদুনিয়া জলমহালটি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রুল এফএম ৭৪৩/২০১২ নং মামলাটির স্থিতাবস্থার আদেশ প্রত্যাহার স্বাপেক্ষে ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে শাপলা মৎস্যজীবী সমিতির নামে ২৯ দশমিক ৫৭ একর জলমহলটি ৬ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথম চার বছর বার্ষিক দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে ও শেষের দু্ই বছর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ বর্ধিত মূল্যে ওই সমিতির অনুকূলে খালটি ইজারা দেয়া হয়। ইজারাদারকে খালটি বুঝিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।
একপর্যায়ে দেবদুনিয়া জলমহাল নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে চলমান সিভিল রুল এফএম ৭৪৩/২০১২ নং মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গেল বছরের ১৪ জানুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং এ আবেদন করেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসীর আরেফীন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোঃ আবুল কাশেম গাজীর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আদালত কর্তৃক গ্রহণপূর্বক মূল দেওয়ানি মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ায় ও মিথ্যা মামলার কারণে সরকার গত ১৫ বছর যাবৎ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার করণে এফএম ৭৪৩/২০১২ নং মামলাটি চলমান থাকার আইনগত কোন যৌক্তিকতা নাই।
ওই জামাল গাজী পুনরায় তার শ্বশুর নুরুল হক মোড়লকে দিয়ে( স্বত্ব আছে বাবদ) মামলা দায়ের করেন। যার নং ৮৫/২৪। নতুন মামলাটি যুগ্ম জেলা জজ চতুর্থ আদালতে চলমান রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল গাজী বলেন, আমি জামাল গাজীকে বছরে ৫৫ হাজার টাকা হারি দিয়ে এক পার্ট (দুই একরের মত) খালে মাছ চাষ করে আসছি।
কালিকাপুরের নূর ইসলাম, নাজিম, জুয়েলসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, পৌষ মাসে ধান লাগাই। আর সারা বছর জমি ফেলানো থাকে। আমন ধানও ভালো হয় না। শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানি পেলে তরমুজ, বোরো ধান, মিষ্টি আলুসহ বিভিন্ন লবন সহিঞ্চু ফসল উৎপাদন করতে পারতাম।
এ বিষয়ে জামাল গাজী বলেন, খালটি আমি ভোগদখল করিনা। আমার পিতা আবুল কাশেম গাজীর পক্ষে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ও পরবর্তী সময়ে শ্বশুর নুরুল হক মোড়লের পক্ষ থেকে দেখাশোনা করি। আর এর আগে স্থানীয় মৎস্য সমিতি ইজারা নিয়ে ভোগদখল করতো। ২০০৯ সালে আয়লার পরে খাল প্লাবিত হয়ে যায়। তিন বছর খাল উন্মুক্ত থাকে। পিতার স্বাক্ষর জাল করে মামলা করার বিষয়ে জানান, তার পিতা নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন। ২০১৮ সালে তার পিতা মামলাটি তুলে নেওয়ার স্বার্থে আইনজীবীদের পরামর্শে জালস্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে আবেদন দিতে বাধ্য হন। ফের তার শ্বশুর মামলা করেন। মামলাটি চলমান রয়েছে।
খুলনা গেজেট/এইচ